প্রশ্ন-১৬৭: নিজ আত্ম সম্মান রক্ষার বিষয়ে কোরআন হাদিসের কোন নির্দেশনা আছে কিনা? দলিলসহ জানালে উপকৃত হতাম।
মাওলানা মোহাম্মাদ আব্দুর রহমান বগুড়া থেকে---
উত্তর:
মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্য বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ভালো গুণের চর্চা ও মন্দ স্বভাব পরিহারের মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তিত্ব গঠন ইসলামী শরিয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুয়াত্তায়ে মালিক, হাদিস : ৮)
আত্মসম্মানবোধ মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রধান দিক। আত্মসম্মানহীন মানুষ মানবীয় অনেক গুণাবলি থেকে বঞ্চিত। ইসলাম মানুষকে আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হতে বলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন আর আল্লাহ তাদের বেশি আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৬১)
আল্লাহর আত্মমর্যাদা সবচেয়ে বেশি
ইসলাম ব্যক্তির আত্মমর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তবে মুমিনের আত্মমর্যাদা সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছে, ‘সব হারাম আত্মমর্যাদার পরিপন্থী।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর চেয়ে বেশি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কেউ নেই। এ জন্য তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব ধরনের অশ্লীলতা হারাম করেছেন। প্রশংসা আল্লাহর সবচেয়ে পছন্দের। তাই নিজের প্রশংসা নিজে করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৮)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলার আত্মমর্যাদাবোধ আছে এবং আল্লাহর আত্মমর্যাদাবোধ এই যে যেন কোনো মুমিন বান্দা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২২৩)
আত্মমর্যাদা মানুষকে সৎ হতে এবং সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে—তাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আত্মমর্যাদা ঈমানের অংশ আর আচরণে উগ্রতা কপটতার লক্ষণ।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০/২২)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘এমন কিছু আত্মসম্মানবোধ আছে যা মহান মহিয়ান আল্লাহ পছন্দ করেন, আবার আত্মসম্মানবোধ এমনো আছে যা মহান আল্লাহ অপছন্দ করেন। ...আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় আত্মসম্মানবোধ হলো সন্দেহ ও বদনামের ক্ষেত্রে যে আত্মসম্মানবোধ কাজ করে। আর আল্লাহর অপছন্দনীয় আত্মসম্মানবোধ হলো সন্দেহ ও বদনামের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যত্র যে আত্মসম্মানবোধ কাজ করে। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৫৫৮)
আল্লাহ সবচেয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। কোরআনে মুমিনকে আল্লাহর রং ধারণ করতে বলা হয়েছে। তাই ঈমানের দাবি হলো, মুমিন আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমরা আল্লাহর রং ধারণ করলাম। রঙে আল্লাহর চেয়ে কে বেশি সুন্দর? এবং আমরা তাঁরই ইবাদত করি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৩৮)
নিজের ও পরিবারের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে কেউ নিহত হলে ইসলাম তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেছে। তবে তা অবশ্যই মিথ্যা ও জাগতিক অহংকারপ্রসূত সম্মানবোধ নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার পরিবারের (সম্মান রক্ষার) জন্য নিহত সে শহীদ, যে তার দ্বিন রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে আত্মরক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪০৯৫)
কোরআনে আত্মমর্যাদাহীন মানুষের নিন্দা
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আত্মমর্যাদাহীন নির্লজ্জ মানুষের নিন্দা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা কোনো অশ্লীল কাজ করে, তারা বলে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষকে এই কাজ করতে দেখেছি এবং আল্লাহ আমাদের এর নির্দেশ দিয়েছেন। বলুন! নিশ্চয়ই আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২৮)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তাদের পরে এলো অপদার্থ উত্তরসূরিরা, তারা নামাজ নষ্ট করল এবং লোভের বশবর্তী হলো। সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি ভোগ করবে।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৯)
আল্লাহ সবাইকে আত্মমর্যাদার দৌলত দান করুন। আমিন।
উত্তর দিচ্ছেন, হাফেজ মাওলানা হেলাল কবির (কক্সবাজার)
উত্তর: আল-হামদুলি্লাহ এ প্রশ্নের জবাব আমার সম্মানিত, মেধাবী আলেম হেলাল কবির সাহেব দিয়েছেন, আমি সাথে একটু যুক্ত করতে চাচ্ছি, প্রথমে জাযাকাল্লাহু খয়র মুহতারাম আব্দুর রহমান সাহেবকে যিনি সময় উপযোগী একটি সাওয়াল করেছেন। কুরআন-হাদিসের নস পেলে হয়তো আমলের ইসপ্রিট বেড়ে যাবে ইনশাল্লাহ ।--------
আত্মসম্মানের হেফাজত করা, নিজেকে লাঞ্ছিত না করা
وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا অর্থ: এবং যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং অসার ক্রিয়া-কালাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় মর্যাদার সাথে তা পরিহার কর চলে। সূরা ফুরকান-৭২
তারা যখন অনর্থক কার্যকলাপের মজলিস দিয়ে অতিক্রম করে তখন ভদ্রভাবে অতিক্রম করে। তারা এই ধরণের মজলিসকে তো উদ্দেশ্য করে যোগ দেয়-ইনা উপরুক্ত যদি আকস্মিকভাবে এমন মজলিসের নিকট দিয়ে অতিক্রম করতে হয় তখনও তারা ইহার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। ইব্রাহিম ইবনে মায়সার (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) একটি খেলার নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন। কিন্তু তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে সোজা চলে গেলেন। তা জানতে পেরে বললেন, لقد اصبح ابن مسعود و امسى كريكا ইবনে মাসউদ আজ বড়ই ভদ্র প্রমাণিত হয়েছে। সূত্র : তাফসিরে ইবনে কাসির ৮ম খণ্ড;২৫০ পৃষ্ঠা; অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারূক (রহ.) অনূদিত,ই.ফা.
عَنْ حذيفة بن اليمان قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَنْبَغِي لِمُؤْمِنٍ أَنْ يُذِلَّ نَفْسَهُ؛ يَتَعَرَّضُ مِنَ البَلَاءِ لِمَا لَا يُطِيْقُ.
অর্থ: হজরত হুজাইফা (রা.)থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ)বলেছেন: মুমিনে কাম্য নয় সে নিজেকে লাঞ্ছিত করা। লোকেরা জিজ্ঞেস করেো, হে আল্লাহর রসূল ! নিজেকে লাঞ্ছিত করে কিভাবে ? তিনি (নবিজি) বললেন, এমন বিপদাপদ কামনা করা যা সহ্য করা সাধ্যাতীত। তাখরিজ : তিরমিজি-২২৫৪,ইবনে মাজাহ-৪০১৬,আহমদ-২৩৪৪৪
আল্লাহ তাআলা আপন বান্দার সাধ্যের বাহিরে হুকুম আরোপিত করেননি। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুমিনদেরকে সমাদৃত দান করেছেন। তিনারাই আবার সে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিকে সংরক্ষণের তাকিদ দিয়েছেন। সুতরাং এমন কাজ করা যাবে না যা অপমানের কারণ হয়। সরাসরি অপমানজনক কাজ থেকে দূরে থাকা সবাই জানে, কিন্তু রসূল(ﷺ) আমাদেরকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, অনুরূপ সম্মানজনক কাজে আত্মনিয়োগ করা যার পরিণতি শুধু অপমান-অপদস্থ তা মুমিনের শান-কাজ হতে পারে না।
অপবাদের রাস্তা থেকে বেঁচে থাকা : মুমিন শুধু পাপ কাজ থেকে থাকবে না বরং পাপের রাস্তা-জায়গা অর্থাৎ যেখানে তার উপস্থিতি অপবাদের আশঙ্কা-সংশয় এবং অপরের কুধারণা জন্ম বা সম্ভবনা থাকে; সেখান থেকেও দূরে-সর্তক থাকবে। নিম্নে একটি হাদিস শরিফ দ্বারা প্রমাণিত হয়। যেমনঃ
أَخْبَرَنِي عَلِيُّ بْنُ الحُسَيْنِ رضي الله عنهما أَنَّ صَفِيَّةَ -زَوْجَ النَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم -- أَخْبَرَتْهُ أَنَّهَا جَاءَتْ رَسُولَ اللهِ - صلى الله عليه وسلم - تَزُورُهُ فِي اعْتِكَافِهِ فِي المَسْجِدِ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ، فَتَحَدَّثَتْ عِنْدَهُ سَاعَةً، ثُمَّ قَامَتْ تَنْقَلِبُ، فَقَامَ النَّبِيُّ - صلى الله عليه وسلم - مَعَهَا يَقْلِبُهَا، حَتَّى إِذَا بَلَغَتْ بَابَ المَسْجِدِ عِنْدَ بَابِ أُمِّ سَلَمَةَ مَرَّ رَجُلاَنِ مِنَ الأَنْصَارِ، فَسَلَّمَا عَلَى رَسُولِ اللهِ - صلى الله عليه وسلم -، فَقَالَ لَهُمَا النَّبِيُّ - صلى الله عليه وسلم -: "عَلَى رِسْلِكُمَا، إِنَّمَا هِيَ صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَيٍّ". فَقَالَا: سُبْحَانَ اللهِ يَا رَسُولَ اللهِ! وَكَبُرَ عَلَيْهِمَا. فَقَالَ النَّبِيُّ - صلى الله عليه وسلم -: "إِنَّ الشَّيْطَانَ يَبْلُغُ مِنَ الإِنْسَانِ مَبْلَغَ الدَّمِ، وَإِنِّى خَشِيتُ أَنْ يَقْذِفَ فِي قُلُوبِكُمَا شَيْئًا".
অর্থ: নবি সহধর্মিণী সাফিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত। একদিন তিনি রমজানের শেষ দশকে মসজিদে আল্লাহর রসূল (ﷺ) -এর খেদমতে উপস্থিত হন। তখন আল্লাহর রসূল (ﷺ) ইতেকাফরত ছিলেন। সাফিয়া তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেন। অতঃপর ফিরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ান। নবি (ﷺ) তাঁকে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালেন। যখন তিনি উম্মু সালামা(রা.)এর গৃহ সংলগ্ন মসজিদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন দুজন আনসারি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়ে আল্লাহর রসূল(ﷺ)-কে সালাম করলেন। তাঁদের দুজনকে নবি রসূল(ﷺ)বললেন : তোমরা দুজন থাম। ইনি তো (আমার স্ত্রী)সাফিয়া বিনতে হুয়ায়ি (রা.)। এতে তাঁরা দুজনে সুবহানাল্লাহ হে আল্লাহর রসূল! বলে উঠেন এবং তাঁরা বিব্রত বোধ করলেন। নবি (ﷺ) বলেন, শয়তান মানুষের রক্তের শিরায় চলাচল করে। আমি ভয় করলাম যে, সে তোমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। বুখারি-২০৩৫; মুসলিম-২১৭৫;আবু দাউদ-২৪৭০;ইবনে মাজাহ-১৭৭৯;দারেমি-১৮২১;আহমদ-২৬৮৬৩
প্রিয় পাঠক! নিষ্পাপ নবি যদি এত সতর্কতাবলম্বন করেছেন; তাহলে আমাদের আরও কত সজাগ হওয়া উচিত তা সহজেই অনুমেয়।
মুসলিম হিসেবেই আমি মরতে চাচ্ছি, তখন আমার নেই কোন পরোয়া নেই।
আল্লাহর পথে কিভাবে আমার প্রাণটি যাবে। আমার মৃত্য হচ্ছে আল্লাহর পথে।
আর কর্তিত জোড়াগুলির ওপর বরকত নাজিল করেন, যদি তিনি চান।
আর হজরত খুবায়েব (রা.) ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলমান যিনি আল্লাহর পথে গ্রেফতার হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের জন্য নিহত হবার পূর্বে নামাজ পড়ার সুন্নাত জারি করেন। তাখরিজ : বুখারি- তাখরিজ : বুখারি-৩০৪৫; আবু দাউদ-২৬৬০;আহমদ-৭৮৬৯;৮০৩৫
নোট : হাদিসটির অংশ বিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে।
হায়! মুসলিম জাতি মৃত্যুর ভয় করে এমন ধারণা যেন না জন্মে, সে জন্য তিনি নামাজের মত মহতি ইবাদত সংক্ষেপ করলেন। আজ আমরা হাজারো অপকর্মে লিপ্ত। আমাদের আমল-আখলাকের দরুন পবিত্র ধর্ম আজ কুলষিত, অপমানিত, ধৃকিত ও ঘৃণিত হচ্ছে।
হে আমার মুসলিম জাতি! হজরত খুবায়েব (রা.) তাঁর জীবন সায়াহ্নে এমন ছবক শিক্ষা দিলেন তা থেকে যদি আমরা শিক্ষা অর্জন করি, তাহলে অমুসলিম জাতি ইসলামের সৌন্দর্য-মহানুভবতা দেখে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে দলে দলে আশ্রয় নিত। হে আল্লাহ! আমাকেসহ সব মুসলমানকে সেই উন্নত-সুউচ্চ আখলাক নিজ দয়ায় দান করুন। ( সূত্র: ‘মহান আল্লাহর নিকট একজন মুমিন-মুসলমানের মর্যাদা-মূল্য, লেখক- মো: আব্দুর রাজ্জাক )
و الله أعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক