আল-বুরহান ( দলিল-প্রমাণ)

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। একটু নিচে দেখুন> বিষয় ভিক্তিক সাজানো রয়েছে, আপনার পছন্দ অনুযায়ী পাঠ করুন এবং পোষ্টগুলো ভালো লাগলে শেয়ার করুন আর আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে এই নাম্বারে- ০১৬৮৭-১১৩৮৮০ হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিন । জাযাকাল্লাহু খাইর।

জিজ্ঞাসা -১২৬৭১: হাদিসের অর্থ, মর্ম ও ব্যাখ্যা

No Comments

 


জিজ্ঞাসা-১২৬৭১

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। 

নিচের হাদীসটির প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে সরল তরজমা জানতে চাই।جاء رجل الى الزبير بن العوام رض فقال اقتل لك عليا؟ قال لا وكيف تقتله ومعه الجنود؟ قال الحق به فافتك به قال لا، ان رسول الله قال: ان الايمان قيد لا يفتك مؤمن ،احمد٣/١٩

তারিখ:  ১১/০৭/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি                       

 

মাওলানা  আবুসুমাইয়া মোঃ শাহজাহান শেখ , কুমিল্লা থেকে।


 জবাব:  وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

 نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم 

 

তাসলিম ও হামদ-সানার পর  প্রথম কথা হলো, আপনার প্রশ্নের আলোকে হাদিসটির সরল অনুবাদ নিম্নরূপ:

جاء رجل الى الزبير بن العوام رض فقال اقتل لك عليا؟ قال لا وكيف تقتله ومعه الجنود؟ قال الحق به فافتك به قال لا، ان رسول الله قال: ان الايمان قيد لا يفتك مؤمن ،احمد٣/١٩

অর্থাৎ অর্থাৎ জনৈক ব্যক্তি একবার হযরত যুবাইর বিন আওয়ামের কাছে এসে বললো, আমি কি আপনার পক্ষ হয়ে আলীকে হত্যা করবো? তখন তিনি বললেন, কক্ষনোই না। আর তুমি তাকে হত্যা করবেই বা কিভাবে? কারণ তিনি তো সদা সৈন্যপরিবেষ্টিত হয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মাঝে বসবাস করে থাকেন! তখন তিনি বলেন, আমি (ছদ্মবেশ ধারণ করে) তার সাথে মিশে যাবো। (পরে সুযোগ বুঝে) তার উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবো। তখন যুবাইর ইবনুল আওয়াম বলেন, না! এটা তুমি করতে পারোনা। 

নিশ্চয়ই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ঈমানের দাবী এই যে, কাউকে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করা যাবে না। কাজেই, কোন মু‘মিন কাউকে ধোঁকা দিয়ে মারবে না। তাখরিজ: মুসনাদে আহমদ -১৪২৬; মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক -৯৬৭৬; আবু দাউদ-২৭৬৯


নোট: সুনানে আবু দাউদে হজরত আবু হুরাইরা থেকে হাদিসটি বর্ণিত আছে, তবে হাদিসের শেষের অংশটুকু।


প্রেক্ষাপট: হজরত ওসমান রা এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে, দ্রুত হত্যার বিচার দাবিতে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়।


এক পক্ষে, আমিরুল মুমিনীন হজরত আলী রা, অপরপক্ষে হজরত আয়েশা, জুবায়ের, তালহা রা।


শেষ পর্যন্ত জঙ্গে জামাল যুদ্ধ ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ যা উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা (Arabic জামালের যুদ্ধ) (জঙ্গে জামাল) বা (English: Battle of the Camel) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে তালহা-হযরত জুবায়ের (রাঃ) ও আয়েশা সম্মলিত যুদ্ধ।

ঐ সময় হজরত জুবায়ের রা. এর পক্ষের লোক হজরত আলি রা. কে গুপ্ত হত্যা করার অনুমতি প্রার্থনা করলে, জবাবে হজরত জুবায়ের রা অস্বীকার করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস উল্লেখ করেন। অর্থাৎ গুপ্ত হত্যা মুমিনীনের শান হতে পারে না।


ব্যাখ্যা:

جاء الإسلامُ ليُهذِّبَ المسلِمينَ في كُلِّ شيءٍ؛ في عاداتِهم وتَقاليدِهم وأخلاقِهم، فيَنْبغي على المُسلِمِ أنْ يَعْلَمَ أنَّ اللهَ لم يَتْرُكْه هَمَلًا ولم يَخْلُقْه سُدًى.

وفي هذا الحَديثِ يقولُ الرَّسولُ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم: "الإيمانُ قَيَّدَ الفَتْكَ"، أي: إنَّهُ يَمْنعُ الفَتْكَ، والفَتْكُ: هو أنْ يأتيَ الرَّجُلُ غيرَه وهو غافِلٌ، فيَشُدَّ عليه فيَقْتُلَه اغتِيالًا وغَدْرًا، والفَتكُ أيضًا القَتلُ بعدَ الأمانِ، والغَدرُ بعدَ التَّأمينِ "لا يَفْتِكُ مؤمِنٌ"، أي: لا يَليقُ بشأنِ المؤمنِ أنْ يَقْتُلَ أحدًا غَدْرًا.

والمعنى: أنَّ الإيمانَ منَعَ ذلك؛ فلا يَنبغي للمُؤمِن أنْ يَفعلَه مع أيِّ أحدٍ، حتَّى لو كان كافِرًا؛ فإنَّه يَنبغي ألَّا يُفتَكَ به حتَّى يُبيَّنَ له ويُدْعَى إلى الإسلامِ أو يُستَتاب، وأمَّا ما ورَد مِن بَعضِ القضايا التي فيها أنَّ رسولَ اللهِ صلَّى الله عليه وسلَّم بعَثَ بَعضَ الصَّحابةِ لقَتْلِ بَعضِ الكُفَّارِ غيلةً، كبَعْثِ مُحمَّدِ بنِ مَسلمةَ في نَفرٍ إلى كَعبِ بن الأشرفِ فقتلوه، وغير ذلك من القَضايَا؛ فقِيل: إنَّ النَّهيَ عن الفَتْكِ كان بعدَ هذه القَضايا، فكأنَّه ناسِخٌ لها. وقيل: بلْ يَحتمِل أنَّ تِلك القَضايا كانتْ بأمرٍ سماويٍّ؛ لِمَا ظَهَر مِن المقتولِينَ مِن الغدرِ برَسولِ اللهِ صلَّى الله عليه وسلَّم والمبالغةِ في أذيَّتِه والتَّحريضِ عليه؛ وعليه يكونُ هذا الحُكمُ مُستمرًّا إذا دعَا إليه داعٍ، كأنْ يُعلَمَ من الكافرِ أنَّه مُصرٌّ على كُفرِه حريصٌ على قَتْلِ المسلِمينَ مُنتهزٌ للفُرَصِ منهم، ولا يَتيسَّر دفْعُه إلَّا بالفَتكِ؛ فلا حرَجَ في ذلك.

وفي الحَديثِ: أنَّ مِنْ ثَمراتِ الإيمانِ تهذيبَ الإنسانِ.

অর্থাৎ, ইসলামের শুভাগমন ঘটেছিলো মুসলমানদের আচার-ব্যবহার, নিত্যকার কার্যকলাপ, নিত্যনৈমিত্তিক কর্মযজ্ঞ, প্রাত্যহিক অভ্যাস, ঐতিহ্যকে পরিশীলিত করার জন্য। তাই প্রত্যেক মুসলমানের এই কথা জেনে রাখা দরকার যে, তাকে আল্লাহ বল্গাহীনভাবে ছেড়ে দেননি, এবং তাকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। 


   এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, " অতর্কিত আক্রমন বা গুপ্ত হামলাকে ঈমান নিষিদ্ধ করেছে ।

আরবী فَتْك শব্দের অর্থ হলো, কোন ব্যক্তি অতিসন্তর্পণে আরেকজনের অগোচরে তার কাছে গিয়ে তাকে বেঁধে ফেললো। তারপর সুকৌশলে তার প্রাণনাশ ঘটালো। 

   শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো, কাউকে তার জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার করে পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা, আশা দিয়ে নিরাশ করা।

আল্লাহর রাসূলের অমীয় বাণী-

لا يفتك مؤمن: 

অর্থাৎ, কোন মুমিন ব্যক্তর জন্য শোভনীয় নয় যে, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কাউকে হত্যা করা। সুতরাং এ জাতীয় প্রতারণার আশ্রয় নেয়া কোন মু'মিন ব্যক্তির সাথে তো দূরে থাক, কোন স্বধর্মত্যাগী কাফেরের সাথেও ও তা সমীচীন নয়। কারণ তাদের বিরুদ্ধেও মৃত্যদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কয়েকটি সুবিদিত স্তর- যেমন তাদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হবে, ইসলামকে নিয়ে তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল সংশয়গুলোর অপনোদনে যথাযথ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে হবে। তারপর তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করতে হবে, কিংবা তাদেরকে তাওবা করতে বলা হবে, প্রভৃতি। 

  তবে যে কয়েকটি ঘটনা থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর জন্য জন্য সাহাবায়ে কেরামের ঝটিকা বাহিনীকে প্রেরণ করেছিলেন,( যেমন বনু কুরাইযা গোত্রের ইহুদি নেতা কা'ব বিন আশরাফকে গুপ্ত আক্রমনের উদ্দেশ্য মুহাম্মাদ বিন মাসলামা'র নেতৃত্বে ঝটিকা বাহিনী প্রেরণ ইত্যাদি) সেগুলো হলো, নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত হাদীসের বিধানটি প্রণয়নের পূর্বেকার ঘটনা। সুতরাং বক্ষমান হাদীসটি এতদসংস্লিষ্ট পূর্ববর্তী সকল ঘটনার নাসেখ ( রহিতকারী)। 


   আবার বলা যেতে পারে, গুপ্তহত্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো হলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা স্বয়ং ঐশী নির্দেশেই বাস্তবায়িত হয়েছে। কারণ অব্যহতভাবে কাফেরদের বৈরী আচরণের বদলা নেয়ার উদ্দেশ্যে অনেকটা প্রতিশোধ গ্রহণের ছলে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূলকে এরূপ আদেশ দিয়েছেন। কারণ যাদেরকে গুপ্তহত্যা করা হয়েছিলো, তারাই প্রথমে মহানবীর সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলো। তার উপর নানারকম নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছিল, শুধু তারা নিজেরা কষ্ট দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং অন্যদেরকেও তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিলো। এইদিক বিবেচনায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের গুপ্তহত্যার ঘটনাগুলোর বিধাম মানসুখ (রহিত) হয়ে যায়নি। বরং তার বিধান আজও বলবৎ আছে। প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে গুপ্ত আক্রমণের বৈধতা বর্তমানেও রয়েছে। যেমন, কোন কাফেরে ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেলো যে, সে মুসলমানদের ব্যাপারে চরমভাবে ঘৃণা পোষণ করে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ হৃদয়ে লালন করে। এমনকি মুসলমানদের অনিষ্ট সাধনে সদা তৎপর হয়ে সে সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকে। কোন মুসলমানকে একবার বাগে পেলেই তার উপর হামলে পড়তে তার বুক একটিবারও কাঁপবেনা, এমনি তাকে নির্ঘাত খুন করে বসবে। এমতাবস্থায় , গুপ্তআক্রমন করা ব্যতীত যদি তাকে দমানো অসম্ভবপর হয়ে ওঠে, তাহলে ছলে-বলে -কৌশলে তাকে দমন করাতে কোন সমস্যা নেই।


সহীহ হাদীসের ভাষ্যমতে, ঈমানের যথাযথ কার্যকারিতা তখনই প্রকাশ পাবে, যখন মানুষের আভ্যন্তরীণ সত্তা পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত হয়ে উঠবে। সূত্র: আলমাউসুআতুল হাদিস, আলাও ইবনে আব্দুল কাদের আসসাক্কাফ হাফিজাহুল্লাহ তাআলা 



 والله اعلم بالصواب

উত্তর প্রদানে মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জা

সহযোগিতায়, মুফতি আসাদুল ইসলাম