জিজ্ঞাসা-১২৬৮০:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
মুহতারাম, মুসাফির সাব্যস্ত হওয়ার শর্তসমূহ কি কি??
তারিখ: ১৮/০৭/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা মাহমুদুল হাসান, ঘাটাইল টাঙ্গাইল থেকে।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর প্রথম কথা হলো, কয়েকটি শর্তাপেক্ষে মুসাফির হিসেবে গণ্য হয়। যেমন,
০১। ফিকহি হানাফির মতে, ১৪ দিন বা তার কম সময় কোথাও থাকার নিয়তে বের হওয়া। দলিল:
হাদিস/আসার নং-০১
عن ابن عمر رضي الله عنهما: إذا كنت مسافراً فوطنت نفسك على إقامة خمسة عشر يوماً فأتمم الصلاة وإن كنت لا تدري فاقصر
ইবন উমার রা. বলেন, তুমি যদি মুসাফির হও এবং ১৫ দিন অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর তাহলে সালাত পূর্ণ করবে। আর যদি তুমি না জান যে কতদিন থাকবে তাহলে সালাত সংক্ষেপ (কসর) করবে।
নোট:
তাহাবি ইবন আব্বাস ও ইবন উমার থেকে অনুরূপ মত সঙ্কলন করেছেন)। [মুহাম্মাদ, কিতাবুল আসার, হাদীস-১৮৮]
হাদিস/আসার নং-০২
عن مجاهد قال: كان ابن عمر رضي الله عنهما كان إذا أجمع على إقامة خمسة عشر يوماً أتم الصلاة
তাবিয়ি মুজাহিদ বলেন, ইবন উমার রা. যখন ১৫ দিন অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তখন সালাত পূর্ণরূপে (চার রাকআত) আদায় করতেন। তাখরিজ: ফিকহুস সুনান, হাদীস নং ৯৩৮
নোট:
(ইবন আবী শাইবা ও মুহাম্মাদ কিতাবুল হাজ্জ-এ। তাদের উভয়ের সনদ সহীহ)। [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীস-৮২১৭]
০২. ফিকহি হানাফির মতে, ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার ( প্রায়) দূরে কোথাও বের হওয়া। দলিল:
হাদিস নং -০১
হজরত ইবন আব্বাস রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
يَا أَهْلَ مَكَّةَ ، لا تَقْصُرُوا الصَّلاةَ فِي أَدْنَى مِنْ أَرْبَعَةِ بُرُدٍ
হে মক্কাবাসী! চার বারীদের কমে কসর করবে না। তাখরিজ: দারা কুতনি ১/৩৮৭
হাদিস নং-০২
وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ، يَقْصُرَانِ، وَيُفْطِرَانِ فِي أَرْبَعَةِ بُرُدٍ وَهِيَ سِتَّةَ عَشَرَ فَرْسَخًا
ইবনে উমর রাযি এবং ইবনে আব্বাস রাযি চার বারীদ সফরের সময় কসর পড়া এবং রোযা ভাঙ্গার কথা বলেছেন। আর সেটি হল, ১৬ ফরসখ। তাখরিজ: বুখারি-১০৮৬, নামায কসর করা অধ্যায়
ব্যাখ্যা:
এক ফরসখ তিন মাইল হয়ে থাকে। সুতরাং প্রত্যেক বারীদ হয় ১২ মাইল। আর চার বারীদকে ১২ দিয়ে গুণ দিলে কিংবা ষোল ফরসখকে তিন দিয়ে গুণ দিলে হয় ৪৮ মাইল। অতএব, সফরের দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে ৪৮ মাইল। সূত্র: কামুসুল ফিকহ ২/৩১৪ আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ১/৭৫
হাদিস নং-০৩
عن عمر رضي الله عنه قال: تقصر الصلاة في مسيرة ثلاث ليال
উমার রা. বলেন, তিন রাতের দূরত্বে সালাত সংক্ষিপ্ত করা হবে। তাখরিজ: ফিকহুস সুনান, হাদীস নং ৯৩৩
নোট:
মুহাম্মাদ কিতাবুল হাজ্জ-এ সহীহ সনদে সুওয়াইদ ইবন গাফলাহ থেকে অনুরূপ মতামত সঙ্কলিত করেছেন)। [তাবারি, তাহযীবুল আসার, হাদীস-১২৫৯; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবা, হাদীস-৮১৩০]
ব্যাখ্যা: একজন ব্যক্তি সাধারণত একদিনে ১৬ মাইল হাঁটতে পারে। তিন দিয়ে গুণ করলে ৪৮ মাইল হয়।
০৩. নিজ এলাকা তথা যে গ্রাম বা শহর বসবাস করে, তার সীমানা থেকে বের হলে, তারপর মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। দলিল:
عن ابن عمر رضى الله عنه أنه كان يقصر الصلاة حين يخرج من بيوت المدينة، ويقصر إذا رجع حتى يدخل بيوتها (مصنف عبد الرزاق، باب المسافر متى يقصر إذا خرج مسافرا-2\530، رقم-4323)
অর্থাৎ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি যখন মদীনার ঘর/শহর থেকে বের হতেন তখন নামায সংক্ষিপ্ত করতেন এবং ফিরে আসার সময় নামায সংক্ষিপ্ত করতেন যতক্ষণ না তিনি তার ঘরে/ মদিনার শহরে প্রবেশ করেন। তাখরিজ: মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক -৪৩২৩
০৪. নিজ জন্মভূমি বা যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং দুটি গ্রাম/শহরে বাড়ি থাকে তাহলে দুটি জায়গায় কখনো মুসাফির হবে না। দলিল:
وإن لم يكن وطنا أصليا له، فإنه يقصر الصلاة ما لم ينوى الإقامة بها خمسة عشر يوما (قاضى خان على الهندية-1\165، جديد-1\104)
অর্থাৎ আর যদি তা তার আদি জন্মভূমি না হয়, তবে সে নামায সংক্ষিপ্ত করবে যদি না সে সেখানে পনের দিন থাকার ইচ্ছা করে। সূত্র: ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া -১/১৩৯; ফাতওয়ায়ে জাদিদ-১/১৯৯
০৫. নিজ পরিবার-পরিজন যেখানে বসবাস করে, সেখানে মানুষ মাকামে একামত বা মুকিম। তাই মুসাফির হবে না, পূর্ণ সালাত আদায় করতে হবে। দলিল:
فِي مُسْنَدِ ابْنِ أَبِي شَيْبَةَ: حَدَّثَنَا الْمُعَلَّى بْنُ مَنْصُورٍ عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ إبْرَاهِيمَ الْأَزْدِيِّ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْحَارِثِ بْنِ أَبِي ذِئَابٍ، أَنَّ عُثْمَانَ ﵁ صَلَّى بِمِنًى أَرْبَعًا ثُمَّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ «مَنْ تَأَهَّلَ فِي بَلْدَةٍ فَهُوَ مِنْ أَهْلِهَا يُصَلِّي صَلَاةَ الْمُقِيمِ» وَإِنِّي تَأَهَّلْت مُنْذُ قَدِمْت مَكَّةَ، وَرَوَاهُ أَبُو يَعْلَى كَذَلِكَ وَلَفْظُهُ: سَمِعْت رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ «إذَا تَزَوَّجَ الرَّجُلُ بِبَلَدٍ فَهُوَ مِنْ أَهْلِهِ» وَإِنَّمَا أَتْمَمْت لِأَنِّي تَزَوَّجْت بِهَا مُنْذُ قَدِمْتهَا.
অর্থাৎ, ইবনু আবী শায়বা সূত্র পরস্পরায় - মুয়াল্লা বিন মানসূর, ইকরিমা বিন ইব্রাহীম আল আযদী, আবদুর রহমান বিন হারেস হতে বর্ণনা করেন যে, উসমান (রাযি.) মিনা (মক্কা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল) অবস্থানকালে (তিন ও চার রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো কসর না করে) পূর্ণাঙ্গ আকারে আদায় করলেন। এবং তার স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করে বললেন, " রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, " কোন ব্যক্তি যদি নতুন কোন এলাকায় নতুন করে বসতি স্থাপন করে, তাহলে সে ঐ এলাকার অধিবাসী হিসেবেই বিবেচিত হবে। তাই সে "মুকিম" তথা সেখানকার স্থানীয় নাগরিকদের মতো পরিপূর্ণ সালাত আদায় করবে।" আর আমিও মক্কায় আগমনের পর এখানেই নতুন করে সংসার স্থাপন করেছি। তাই আমি সালাত আদায়কালে কসর না করে পরিপূর্ণভাবেই নামাজ পড়ে থাকি।
মুসনাদে আবূ ইয়ালা' হতেও এজাতীয় রিওয়াতের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই গ্রন্থের ভাষ্য হলো নিম্নরূপ -
হজরত উসমান ( রাযি.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, " একজন ব্যক্তি যখন কোন এলাকায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, তখন সে ঐ এলাকারই বাসিন্দা হিসেবে গণ্য হবে।"
উসমান (রাযি.) আরো বলেন, " আমার ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য। কারণ আমি মক্কা আগমনের পর এখানেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছি। আর এজন্যই এখানে আসলে আমি মুকীম (স্থানীয় বাসিন্দা) হিসেবে পূর্ণাঙ্গ সালাত আদায় করি।
সূত্র: কিফায়াহ বিহামেশ ফাতহুল ক্বাদীর- ২/১৭
সারকথা হলো,
فمذهب الحنفية أن قصر الرباعية واجب في السفر، وشرط ذلك أن يكون بين البلدة التي يخرج منها والبلدة التي يقصدها مسيرة ثلاثة أيام، ولا يستبيح القصر إلا إذا جاوز بيوت بلده، ويقصر ما دام مسافرا حتى يعود إلى بلده أو ينوي إقامة خمسة عشر يوما، جاء في متن الاختيار من كتب الحنفية: باب صلاة المسافر وفرضه في كل رباعية ركعتان، ويصير مسافرا إذا فارق بيوت المصر قاصدا مسيرة ثلاثة أيام ولياليها بسير الإبل ومشي الأقدام، ولا يزال على حكم السفر حتى يدخل مصره، أو ينوي الإقامة خمسة عشر يوما في مصر أو قرية، وإن نوى أقل من ذلك فهو مسافر وإن طال مقامه. انتهى بتصرف.
অর্থাৎ হানাফী মাযহাব মতে, সফররত অবস্থায় চার রাকা'ত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো কসর ( সংকোচন করে দু'রাকাত আদায়) করাটা ওয়াজিব ( বাধ্যতামূলক)। তবে তার জন্য শর্ত হলো, নিজ এলাকা হতে গন্তব্যস্থলের দূরসীমা "তিন দিবস পথচলা"র দূরত্ব হতে হবে। তবে সফরে রওয়ানা হওয়ার পর নিজ এলাকার লোকালয় ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কসর সালাত আদায় করা কারো জন্য বৈধ হবেনা। সে যদি গন্তব্যস্থলে পনের দিন অবস্থানের নিয়ত না করে, তাহলে নিজ আবাসভূমিতে ফেরত আসার পূর্ব পর্যন্ত সে মুসাফির বলে বিবেচিত হবে।
হানাফী মাযহাবের প্রামাণ্য গ্রন্থ "ইখতিয়ার" নামক কিতাবে আছে- মুসাফির ব্যক্তির সালাত আদায়ের পদ্ধতিঃ
মুসাফির ব্যক্তি চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজগুলো দুই রাকাত আদায় করবে। কোন ব্যক্তি যদি নিজ এলাকা থেকে লোকালয় ছেড়ে পায়ে হেঁটে কিংবা ঊটের পিঠে চড়ে তিনদিন-তিনরাতের সমপরিমাণ দূরত্বে গমনের উদ্দেশ্যে নিজ এলাকার জনবসতি থেকে বের হয়ে পড়ে, তখন সে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। সে যদি কোন শহর বা জনপদে পনের দিন অবস্থানের নিয়ত না করে তাহলে সে নিজ এলাকায় ফেরত আসার আগ পর্যন্ত মুসাফিরের হুকুমের আওতাভুক্ত থাকবে। পক্ষান্তরে সে যদি পনেরদিনের কম থাকার নিয়ত করে, তাহলে তার অবস্থান যতদিনই দীর্ঘায়িত হোকনা কেন, সে মুসাফিরের হুকুমে থেকে কসর সালাত আদায় করবে। সূত্র: ফিকহুল ইবাদাত, সালাতুল মুসাফির -১২৮৩৭৯ ( ফতোয়া নং)
উল্লেখ্য যে, ৭৮ কিলোমিটার দূরে কোথাও ১৫ দিন থাকার নিয়তে বের হলে, উক্ত জায়গায় মুকিম হিসেবে গণ্য হবে, কিন্তু পথে মুসাফির থাকবে।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক