জিজ্ঞাসা-২৩২ আস সালামু আলাইকুম। দরুদ পাঠের বিধান কী? অনেকে যে (সাঃ), (ছঃ), (দঃ) - এভাবে লিখেন, এতে কি দরুদের হক আদায় হবে? দলিলসহ জানালে উপকৃত হতাম। তারিখ-১০/০৭/২২ ঈসায়ি/ইংরেজ
হাফেজ মাওলানা মো: নুরুল্লাহ বি.বাড়িয়া
জবাব: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ ও বারাকাতুহ। প্রথমে জাযাকাল্লাহ খয়র আমার স্নেহের ছোট ভাইকে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ আমলের ব্যাপারে সওয়াল করেছেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিরাপদে ও শান্তিতে রাখুন। যাইহোক, আপনার প্রশ্নকে সহজভাবে বুঝার জন্য কয়েকভাগে ভাগ করছি।
প্রশ্ন: ক। দরুদ পাঠের বিধান কি?
উত্তর: ক। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا[
অর্থ: আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর। সূরা আহযাব-৫৬
উপরোক্ত আয়াতের উপর ভিত্তি করে ফুকাহায়ে আহনাফ ও মালেক বলেন, আল্লাহ তাআলার আদেশ অনুযায়ী জীবনে একবার হ’লেও দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। সূত্র: আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, ২৭/২৩৪ পৃঃ
Ø ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর মতে তাশাহহুদের পর দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আর ইমাম আবূ হানীফা ও মালেক (রহ.)-এর মতে সুন্নাত। সূত্র: আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-বাসসাম, তায়সীরুল আল্লাম শরহে উমদাতুল আহকাম, ১ম খন্ড (কুয়েত : জমঈয়াতু ইহয়াইত তুরাছ আল-ইসলামী, ১৯৯৪ খৃঃ/১৪১৪ হিঃ), পৃঃ ২৬৮।
Ø ইমাম তাহাবী (রহ.) বলেন, যখনই রাসূল (ﷺ)-এর নাম আসবে তখনই তার প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। আর মুস্তাহাব হ’ল, হাদীছে উল্লেখিত বিভিন্ন সময়ে। যেমন জুম‘আর দিনে, মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়, আযানের পরে, দো‘আর শুরুতে ইত্যাদি। সূত্র: আল-মাউসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, ২৭/২৩৫ পৃঃ
অধিকাংশ ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, কেউ রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর নাম উল্লেখ করলে অথবা শুনলে দরুদ পাঠ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কেননা হাদিসে এরূপ ক্ষেত্রে দরুদ পাঠ না করার কারণে শাস্তিবাণী বর্ণিত আছে। দলিল:
হাদিস নং-০১
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ،
হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, সে ব্যক্তি অপমানিত হোক, যে ব্যক্তির নিকট আমার নাম উচ্চারণকালে সে আমার উপর দরূদ পাঠ করে না। তাখরিজ: সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩৫৪৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৭৪৫১,সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১৮৮৮
হাদিস নং-০২
عَنْ حُسَيْنِ بْنِ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: البَخِيلُ الَّذِي مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ
হযরত হুসাইন বিন আলী বিন আবী তালিব রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, সর্বাপেক্ষাবড় কৃপণ সেই ব্যক্তি, যার নিকট আমার নাম উচ্চারণ করা হলে সে আমার উপর দরূদ পড়ে না। তাখরিজ: সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩৫৪৬
হাদিস নং-০৩
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (ﷺ) বলেছেন, ‘যে সমস্ত লোক কোনো মজলিসে বসেছে অথচ তারা আল্লাহর জিকির করেনি এবং তাদের নবীর প্রতি দরুদও পাঠ করেনি, তারা বিপদগ্রস্ত ও আশাহত হবে। আল্লাহ তাআলা চাইলে তাদের শাস্তিও দিতে পারেন কিংবা মাফও করতে পারেন।’ তাখরিজ: তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৮০
প্রশ্ন: খ। একই মজলিসে/বৈঠকে একাধিকবার প্রিয় নবীজি (ﷺ)-এর নাম উচ্চারিত হলে, করণীয় কি?
উত্তর: খ। একই মজলিসে বার বার নাম উচ্চারিত হলে, একবার দরুদ পাঠ করলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। কিন্তু প্রত্যেকবার পাঠ করা মুস্তাহাব। সূত্র: তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন-সংক্ষিপ্ত, মাওলাণা মহিউদ্দীন খান রহ.-১০৯৫ পৃষ্ঠা
প্রশ্ন: গ। অনেকে যে (সাঃ), (ছঃ), (দঃ) এভাবে লেখে এতে কি দরুদের হক আদায় হবে?
উত্তর: গ। মুখে নাম উচ্চারণ করলে যেমন দরুদ ও সালাম ওয়াজিব, তেমনি কলমে লেখার সময়ও দরুদ ও সালাম ওয়াজিব। সুতরাং (সাঃ), (ছঃ), (দঃ),(সা.),(সা.),(স) (Pbuh), (Pbh), (D), (S), (Sm), (ﺻﻠﻠﻢ) ,(ﺻﻠﻌﻢ) ,(ﻋﻢ) ,(ﺹ যেভাবেই লেখুক না কেন, এক্ষেত্রে সংক্ষেপে লেখা যথেষ্ট নয়। সমপূর্ণ দরুদ ও সালাম লেখা বিধেয়।
দলিল:
পূর্বে উল্লেখিত হাদিসসমূহ এবং নিম্নে একটি পেশ করা হচ্ছে-
প্রিয় নবীজি (ﷺ)-নাম লিখার পর পূর্ণ দরুদ শরীফ লিখা হাদিস শরীফে আদেশ করা হয়েছে-
عن ابن عباس قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: “من صلى عليّ في كتاب، لم تزل الصلاة جارية له ما دام اسمي في ذلك الكتاب
অর্থ: যে ব্যক্তি আঁমার উপর ছলাত বা দরুদ শরীফ লিখবে,সর্বদাই আঁমার নাম মুবারকের সাথে ঐ লিখায় পূর্ণ দরুদ শরীফ লিখবে।
তাখরিজ: মুজামুল কবীর তাবরানী-৪৪৭; মুজামুল আওসাত তাবরানী-১৮৩৫
নোট: কেউ কেউ হাদিসটির সনদকে দুর্বল বলেছেন।
একই মজলিসে/বৈঠকে কয়েকবার তাঁর নাম লিখলে, প্রথমবার দরুদ লেখা ওয়াজিব এবং পরবর্তী প্রত্যেকবার মুস্তাহাব। সূত্র: তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন-সংক্ষিপ্ত, মাওলাণা মহিউদ্দীন খান রহ.-১০৯৫ পৃষ্ঠা
قال السيوطي رحمه الله تعالى في كتابه ” تدريب الراوي في شرح تقريب النواوي ” : ( ويكره الاقتصار على الصلاة أو التسليم هنا وفي كل موضع شرعت فيه الصلاة كما في شرح مسلم وغيره لقوله تعالى : ( صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا ) إلى أن قال : ويكره الرمز إليهما في الكتابة بحرف أو حرفين كمن يكتب ( صلعم ) بل يكتبهما بكمالها ) انتهى المقصود من كلامه رحمه الله تعالى ملخصا .
ইমাম সূয়ুতী বলছেন এটা মাকরুহ। উত্তম হলো صلي الله عليه و سلم পরিপূর্ণ লেখা ص বা صل কিংবা صلعم লেখা মাকরুহ । দেখুন তাদরীবুর রাবী ফি শারহি তাক্বরীবুন নবভী- কিতাবের
আরো দেখুন : মুসলিম শরীফের শরহ ।
এবং وقال العلامة السخاوي ـ رحمه الله تعالى ـ في كتابه (فتح المغيث في شرح ألفية الحديث) للعراقي ما نصه: ( واجتنب أيها الكاتب (الرمز لها) أي الصلاة والسلام على رسول الله صلى الله عليه وسلم في خطك، بأن تقتصر منها على حرفين، ونحو ذلك، فتكون منقوصة صورة كما يفعله (الكسائي)، والجهلة من أبناء العجم غالباً، وعوام الطلبة، فيكتبون بدلاً من صلى الله عليه وسلم (ص) أو (صم) أو (صلعم)، فذلك لما فيه من نقص الأجر لنقص الكتاب خلاف الأولى).
আল্লামা সাখাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহে তার ফতহুল মুগীছ ফি শারহি আলফিয়াতুল হাদীসে ইরাকী থেকে কোড করেন: হে লেখকগণ! দরুদ শরীফ লেখার ক্ষেত্রে চিহ্ন ব্যাবহার থেকে বিরত থাকুন। এবং একি অক্ষর কিংবা দুইটি অক্ষর না লিখে পরিপূর্ণভাবে صلي الله عليه و سلم সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম লিখুন । অনারব- ছাত্র এবং কাছায়ীর মত ص স: লিখবেন না কারন তা পরিপূর্ণ দুরুদ লেখার ফজিলত থেকে বঞ্ছিত হয়। ”
প্রশ্ন: ঘ। কোন কোন স্থানে দরুদ শরিফ পড়া মুস্তাহাব?
উত্তর: ঘ। যেসব স্থানে দরুদ শরিফ পড়া মুস্তাহাব, নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:
(১) রাসুলুল্লাহ (ﷺ)এর নাম উচ্চারণ করলে, লিখলে বা শুনলে। (২) কোনো মজলিস থেকে ওঠার আগে। (৩) দোয়ার শুরুতে, মাঝে ও শেষে। (৪) মসজিদে প্রবেশকালে ও বের হওয়ার সময়। (৫) মুয়াজ্জিনের আজানের জবাব দেওয়ার পর আজানের দোয়ার আগে। (৬) অজু শেষ করে। (৭) নবী করিম (ﷺ)এর রওজা মোবারক জিয়ারতের সময়। (৮) কোনো বই-পুস্তক বা চিঠিপত্র লেখার শুরুতে। (৯) বিপদ-আপদ, বালা-মসিবত, ভূমিকম্প ইত্যাদির অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। (১০) সকাল ও সন্ধ্যা। (১১) সাফা ও মারওয়া সাঈ করার সময়। (১২) জুমা ইত্যাদির খুতবায়। (১৪) তালবিয়া থেকে অবসর হওয়ার পর। (১৫) কোনো কিছু ভুলে গেলে। (১৬) রাগান্বিত হলে। (১৭) হাদিস পাঠের শুরুতে ও শেষে। (১৮) কোনো বিষয়ে ইসলামী সমাধান লেখার শুরুতে। (১৯) পরস্পর একত্র হওয়া ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়। (২০) বৈধ সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের শুরুতে। সূত্র রদ্দুল মুহতার : ২/২৮১-২৮২, দুররে মুখতার : ১/৫১৬, আল কাউলুল বাদি : ২৭, ১৭৪-১৭৫
প্রশ্ন: ঙ। কোন কোন জায়গায় দরুদ শরিফ পাঠ করা মাকরুহ?
উত্তর: ঙ। যেসব স্থানে দরুদ শরিফ পড়া মাকরুহ; নিম্নে
(১) স্বামী ও স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্কের সময়। (২) মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের সময়। (৩) ব্যবসায়িক পণ্যের পরিচিতির জন্য। (৪) কোনো স্থানে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর। (৫) খুতবা শ্রবণকালে। (৬) আশ্চর্য হলে। (৭) হাঁচি দেওয়ার পর। (৮) জবাইয়ের সময়। সূত্র: রদ্দুল মুহতার : ২/২৮২
নোট: বিনা অজুতে এমনকি হাঁটতে হাঁটতেও দরুদ পড়তে কোন অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন: চ। দরুদের লেখার বিষয়ে পূর্বসুরিদের কি নিয়ম ছিল?
উত্তর: চ। আমাদের মহান পূর্বসুরি সকল মুহাদ্দিস,ফুকাহায়ে উম্মত , মুফাস্সিরে কেরামগণ কোথায় সংক্ষেপে দরুদ লেখেননি। বিশ্বাস না হলে, সমস্ত হাদিস, তাফসির ও ফিকাহর গ্রন্থ (মূল কিতাব বাংলা নয়) খুলে দেখুন। লেখা বড় হয়ে যাবে বা বই বৃদ্ধি পেয়ে যাবে, এ কারণে অনেকে সংক্ষিপ্ত করে থাকেন। হায় আফসোস! কতটুকু আর কালি/কাগজ লাগতো? প্রিয় নবীজি (ﷺ)-নাম লিখার ক্ষেত্রে কার্পণ্যতা। সেকি শ্রেষ্ঠ কৃপণ নয়?
ইবনে বায এতদ্ব:সম্পর্কীয় ফতোয়ার শেষে লিখেন
هذا ووصيتي لكل مسلم وقارئ وكاتب أن يلتمس الأفضل ويبحث عما فيه زيادة أجره وثوابه ويبتعد عما يبطله أو ينقصه . نسأل الله سبحانه وتعالى أن يوفقنا جميعا لما فيه رضاه ، إنه جواد كريم وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه .
” مجموع فتاوى الشيخ ابن باز ” ( 2 / 397 – 399 )
সুতরাং এটা আমার ওসিয়্যত যে সকল পাঠক, লেখকরা যাতে উত্তম এবং অধিক সওয়াব এবং প্রতিদানপূর্ণ বিষয়টাকে গ্রহণ করেন এবং সংক্ষিপ্ততা পরিহার করে পরিপূর্ণভাবে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পড়েন ও লিখেন। ----সূত্র: মাজমুউল ফাতাওয়া-২/৩৯৭-৩৯৯
সর্তকতা: আল-হামদুলিল্লাহ আমি কখনও সংক্ষিপ্ত দরুদ লেখি না, তবে মাঝে মাঝে যে আল-বুরহানে দেখা যায়, তা কপি-পেস্ট-এর কারণে হতে পারে, সম্পদনার যথেষ্ট সময় ঘার্তির কারণে/চোখের আড়ালে। পাঠকবৃন্দ! আমার ব্যক্তিগত আইডিতে অবগত করলে ঠিক করে নিব ইনশাল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তার প্রিয় বন্ধুর প্রতি বেশি বেশি পাঠ করার তাওফিক দান করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর দিচ্ছেন,