জিজ্ঞাসা-১২৪৩৩:
মোটিভেশন ক্লাস: ০৯
আস্সালামু আলাইকুম, ধর্মের আলোকে শিষ্ঠাচার কী সামরিক জীবনে শিষ্ঠাচারের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে গোছালে কোন পাঠ পরিকল্পনা কারো নিকট আছে? তারিখ: ১৮/০১/২৩ ঈসায়ি/ইংরেজি
মাওলানা আনওয়ারুল আম্বিয়া যশোর থেকে।
জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
نحمده ونصل على رسوله الكريم اما بعد بسم الله الرحمن الرحيم
তাসলিম ও হামদ-সানার পর কথা হলো, আপনার প্রশ্ন সংক্রান্ত মোটিভেশন ক্লাসটি দুটি স্তরে ভাগ করছি।
ইসলামের আলোকে আদব বা শিষ্টাচার কি/কাকে বলে এবং সামরিক জীবনে এ প্রভাব/প্রয়োজনীয়তা।
ক। প্রথম স্তর: ইসলামের আলোকে আদব বা শিষ্টাচার কি/কাকে বলে?
ভূমিকা: মুসলিম জীবন বিশেষ করে সামরিক জীবনে শিষ্টাচার (আদব-কায়দার) বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র হাদিসে এসেছে -
عَن عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ نَبِىَّ اللهِ ﷺ قَالَ إِنَّ الْهَدْىَ الصَّالِحَ وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ وَالاِقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ وَعِشْرِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ
অর্থ: আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন, নিশ্চয় উত্তম আদর্শ, সুন্দর বেশভূষা এবং মধ্যম পন্থা নবুঅতের পঁচিশ ভাগের একটি ভাগ। তাখরিজ: আবু দাঊদ ৪৭৭৮, তিরমিজি-২০১০
আদব বা শিষ্টাচারের সংজ্ঞা:
আদব শব্দটি আরবি "أدب "শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: শিষ্টাচার, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার। সূত্র: ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, আল মুনীর আরবী-বাংলা অভিধান, দারুল হিকমা বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১০ খ্রি., পৃ. ১৫; বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংষ্করণ: ডিসেম্বর ২০০০, পৃ. ১০৩
প্রমাণ্য সংজ্ঞা:
(০১) ইবন হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন:
« الأدب: استعمال ما يحمد قولاً وفعلاً »
“কথায় ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে।” সূত্র: মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১
(০২) আবার কেউ বলেন:
« الأخذ بمكارم الأخلاق »
“উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলে।” সূত্র: মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১
আবার কেউ কেউ বলেন:
« هو تعظيم من فوقك والرفق بمن دونك »
“আদব হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে সম্মান করা এবং অধস্তনকে স্নেহ করা।” সূত্র: প্রাগুক্ত।
আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’ (শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত) বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ (অশালীন, অভদ্র, অসভ্য) বলে।
ইসলামের দৃষ্টিতে আদব বা শিষ্টাচার:
ইসলাম আপাদমস্তক পুরাটাই আদব। ইসলাম স্রষ্টা ও সৃষ্টির সাথে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।
ক. আল্লাহ তাআলার সাথে আদব: যেমন হাদিস শরিফে এসেছে-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ
اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- اسْتَحْيُوا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ. قَالَ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا لَنَسْتَحْيِى وَالْحَمْدُ لِلَّهِ. قَالَ : لَيْسَ ذَاكَ وَلَكِنَّ الاِسْتِحْيَاءَ مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ أَنْ تَحْفَظَ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى وَتَحْفَظَ الْبَطْنَ وَمَا حَوَى وَتَتَذَكَّرَ الْمَوْتَ وَالْبِلَى وَمَنْ أَرَادَ الآخِرَةَ تَرَكَ زِينَةَ الدُّنْيَا فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدِ اسْتَحْيَا مِنَ اللَّهِ حَقَّ الْحَيَاءِ-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর সত্যিকারের লজ্জা। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা অবশ্যই আল্লাহকে লজ্জা করি- আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বললেন, কথা সেটা নয়। বরং আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, (১) তুমি তোমার মাথা ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর। (২) তুমি তোমার পেট ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর। (৩) আর তোমার বারবার স্মরণ করা উচিৎ মৃত্যুকে ও তার পরে পচে-গলে যাওয়াকে। (৪) আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে, সে যেন পার্থিব বিলাসিতা পরিহার করে। যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজগুলি করে, সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে লজ্জা করে’। তাখরিজ: আহমাদ হা/৩৬৭১; তিরমিযী হা/২৪৫৮, মিশকাত হা/১৬০৮, ‘জানায়েয’ অধ্যায় ‘মৃত্যু কামনা’ অনুচ্ছেদ
নোট: হাদিসটির সনদ হাসান।
ব্যাখ্যা : ‘তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর’ অর্থ আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর ও শ্রদ্ধা কর। অর্থাৎ তার শাস্তির ভয়ে নয় কিংবা কিছু পাওয়ার আশায় নয়। বরং তার বড়ত্ব ও সর্বোচ্চ মর্যাদাকে সম্মান কর।
তাইতো কবি বলেন,
وَإِذا خَلَوتَ بِرِيبَةٍ في ظُلمَةٍ + وَالنَفسُ داعيَةٌ إِلى الطُّغيانِ
فاِستَحي مِن نَظَرِ الإِلَهِ وَقُل لَها + إِنَّ الَّذي خَلَقَ الظَّلامَ يَرانِي
অর্থাৎ ‘যখন তুমি অস্থির হয়ে অন্ধকারে লুকাবে, অথচ প্রবৃত্তি সর্বদা অবাধ্যতার দিকে আহবানকারী’। ‘তখন তুমি আল্লাহর দৃষ্টি থেকে লজ্জিত হও এবং প্রবৃত্তিকে বল, নিশ্চয়ই যিনি অন্ধকারকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাকে দেখছেন’।
খ. নবির সাথে আদব: নবির সাথে কেমন আচরণ হবে তা স্বয়ং আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছে:
Surah Al-Hujraat, Verse 2:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না। সূরা হুজুরাত-০২
গ. সৃষ্টি জগতের সাথে আদব: সৃষ্টি জীবের প্রতি ভাল ব্যবহার সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে-
الخَلقُ عيالُ اللَّهِ ، فأحبُّ الخلقِ إلى اللَّهِ مَن أحسنَ إلى عيالِهِ
الراوي : عبدالله بن مسعود | المحدث : البيهقي | المصدر : شعب الإيمان
الصفحة أو الرقم : 6/2528 | خلاصة حكم المحدث
অর্থ: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ)
বলেছেন, সমগ্র সৃষ্টি জগত আল্লাহ তাআলার পরিবার। আল্লাহর নিকট ঐ সৃষ্টি বেশি প্রিয়, যে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাল/ভদ্র ব্যবহার করে। তাখরিজ: সুনানে বাইয়াকি-২৫২৮
খ। দ্বিতীয় স্তর: সামরিক জীবনে এ প্রভাব/প্রয়োজনীয়তা।
ভূমিকা: আদব বা শিষ্টাচার হল একটি নির্দিষ্ট রূপ যা আত্মনিয়ন্ত্রণ, চরিত্র এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটায়। যে কোনো সশস্ত্র বাহিনী সংস্থার দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য শিষ্টাচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । আদব বা শিষ্টাচার সরাসরি একজন সৈনিকের আচরণকে প্রভাবিত করে এবং এটি সামরিক জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে। নিম্নে কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো,
০১. বড়দের সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন:
হযরত আবু হুরায়রা রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিখ্যাত সাহাবী, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন :
من لم يرحم صغيرنا ولم يعرف حق كبيرنا فليس منا
যে আমাদের ছোটকে দয়া করে না, আমাদের বড়র হক আদায় করে না সে আমাদের নয়। তাখরিজ: সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৪৩; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৩৫৩
ব্যাখ্যা: হাদীসের দ্বিতীয় অংশ,
ولم يعرف حق كبيرنا (এবং যে আমাদের বড়র হক আদায় করে না)। বড় বিভিন্নভাবে হতে পারে। বয়সে বড়, জ্ঞান-প্রজ্ঞায় বড়, অর্থ-বিত্ত-সামাজিক সম্মানের দিক থেকে বড়, পদ-মর্যাদা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে বড়, যে কোনো দিক থেকে যিনি বড়, তার হক আদায় করা ঈমান ও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যে সেই হক আদায় করে না সে فليس منا ‘আমাদের নয়’।
সামরিক জীবন: সামরিক জীবনে সিনিয়র কে সম্মান করা একটি অপরিহার্য অংশ। প্রতিটি সদস্যের রক্ত মাংসে বড়দের সম্মান করা মিশে থাকে।
০২. ছোটদের স্নেহ করা: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, من لم يرحم صغيرنا (যে আমাদের ছোটকে দয়া করে না...) থেকে বোঝা গেল, ছোটর সাথে আচরণ হবে দয়াপূর্ণ, মমতাপূর্ণ। ছোটর সাথে আচরণের মূল ভিত্তি হবে আর রাহমাহ’ দয়া ও মমতা। দয়া-মায়ার আচরণের দ্বারাই ছোটর হক আদায় করা সম্ভব হবে।
সামরিক জীবন: দৈনিক/সাপ্তাহিক/মাসিক দরবার, রুল কলে জুনিয়রদের সমস্যা শোনা হয় এবং কার্যকারী ব্যবস্থা নেয়া হয়। ইউনিটের প্রতিটি সদস্যগণ শান্তিতে আরামে থাকে বড়রা সর্বদাই এই চিন্তা করে।
০৩. স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা: সুন্দর ও স্পষ্ট ভাবে কথা বলা ইসলামের শিক্ষা। যেমন,
عَنْ عَائِشَةَ رَحِمَهَا اللَّهُ، قَالَتْ: "كَانَ كَلَامُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَلَامًا فَصْلًا يَفْهَمُهُ كُلُّ مَنْ سَمِعَهُ
অর্থ: হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কথা বলতেন, খুব স্পষ্ট পরিস্কার ও আলাদা আলাদাভাবে বলতেন। শ্রোতাদের সবাই তা হৃদয়ঙ্গম কর নিতে পারত। তাখরিজ: আবু দাউদ-৪৮৩৯
সামরিক জীবন: সিনিয়র জিজ্ঞেস করলে সুন্দর ও স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দেওয়ায় সামরিক জীবনে ঐতিহ্য।
০৪. মুরুব্বি বা দলনেতা দ্বারা খাবার শুরু করা:
হজরতে সাহাবায়ে কেরামগণ! রসূলুল্লাহ (ﷺ) খাবার শুরু না করলে, তারা শুরু করতেন না। যেমন,
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: كُنَّا إِذَا حَضَرْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَعَامًا لَمْ نَضَعْ أَيْدِيَنَا حَتَّى يَبْدَأَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَضَعَ يَدَهُ،.
অর্থ: হজরত হুজাইফা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে আমরা খাবারে জন্যে দস্তরখানে একত্রিত হলে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) যত সময় পর্যন্ত খাওয়া শুরু না করতেন, তত সময় পর্যন্ত আমরা খানায় হাত দিতাম না। তাখরিজ : মুসলিম-২০১৭
সামরিক জীবন: সরকারি বড় খানা বা কোন পার্টিতে সিনিয়র দ্বারা খাবার শুরু করা সেনাবাহিনীর প্রথাগত ঐতিহ্য।
০৫. সুন্দর নামে ডাকা: ইসলামে মন্দ নামে ডাকা নিষেধ। যেমন, ইরশাদ হচ্ছে:
Surah Al-Hujraat, Verse 11:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। সূরা হুজুরাত-১১
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলিম; যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ। আর যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে, সে-ই প্রকৃত হিজরতকারী৷ তাখরিজ: বুখারি-
সুন্দর নাম মানসিকতা ও স্বভাবের উপর নামের প্রভাব পড়ে। তাই তো আমাদের প্রিয় নবি (ﷺ) সাহাবাদেরকে নাম পরিবর্তন ও সুন্দর সুন্দর উপাধিতে ডাকতেন। যেমন,
হাদিস নং-০১
أَخْبَرَنِي عَبْدُ الحَمِيدِ بْنُ جُبَيْرِ بْنِ شَيْبَةَ، قَالَ: جَلَسْتُ إِلَى سَعِيدِ بْنِ المُسَيِّبِ، فَحَدّثَنِي: أَنّ جَدّهُ حَزْنًا قَدِمَ عَلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَقَالَ: مَا اسْمُكَ؟ قَالَ: اسْمِي حَزْنٌ، قَالَ: بَلْ أَنْتَ سَهْلٌ. قَالَ: مَا أَنَا بِمُغَيِّرٍ اسْمًا سَمّانِيهِ أَبِي قَالَ ابْنُ المُسَيِّبِ: فَمَا زَالَتْ فِينَا الحُزُونَةُ بَعْدُ.
আবদুল হুমাইদ বিন শায়বা বলেন, আমি হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিবের কাছে বসা ছিলাম। তিনি তখন বললেন, আমার দাদা ‘হাযান’ একবার নবীজীর দরবারে উপস্থিত হলেন। নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী? দাদা বললেন, আমার নাম হাযান। (হাযান অর্থ শক্তভূমি) নবীজী বললেন- না, তুমি হচ্ছ ‘সাহল’ (অর্থাৎ তোমার নাম হাযানের পরিবর্তে সাহল রাখো; সাহল অর্থ, নরম জমিন।) দাদা বললেন, আমার বাবা আমার যে নাম রেখেছেন আমি তা পরিবর্তন করব না। সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন, এর ফল এই হল যে, এরপর থেকে আমাদের বংশের লোকদের মেযাজে রুঢ়তা ও কর্কশভাব রয়ে গেল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৯৩
হাদিস নং-০২
মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে আতা বলেন, আমি আমার মেয়ের নাম রাখলাম- বাররা (নেককার, ভালো মানুষ)। তখন যয়নব বিনতে আবি সালামা বললেন-
سُمِّيتُ بَرّةَ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لَا تُزَكّوا أَنْفُسَكُمْ، اللهُ أَعْلَمُ بِأَهْلِ الْبِرِّ مِنْكُمْ فَقَالُوا: بِمَ نُسَمِّيهَا؟ قَالَ: سَمّوهَا زَيْنَبَ.
আমার নাম ছিল, বাররা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা ঘোষণা কোরো না। (কারণ, বাররা অর্থ, ভালো, নেককার, পূত-পবিত্র) আল্লাহই জানেন তোমাদের মধ্যে ভালো ও পূত-পবিত্র কারা। জিজ্ঞেস করা হল, তাহলে আমরা তার কী নাম রাখতে পারি? তখন নবীজী বললেন, তার নাম যয়নাব রাখ। (নবীজীর আদেশে তখন বাররা নাম পরিবর্তন করে তার নাম যয়নাব রাখা হল।) তাখরিজ: সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৪২
হজরত আবু বকর রা. কে সিদ্দিক এবং ওমর হলেন আল-ফারুক। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ``হে আল্লাহর রাসূল! বর্তমানে মুসলমানের সংখ্যা কত? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, ``তোমাকে নিয়ে ৪০ (চল্লিশ) জন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এটাই যথেষ্ট। আজ থেকে আমরা এই চল্লিশ জনই কাবা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে মহান আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করবো। ভরসা মহান আল্লাহর। অসত্যের ভয়ে আর সত্যকে চাপা পড়ে থাকতে দেব না। সেদিনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে "ফারুক" উপাধি দেন।
হজরত আলি রা.কে আসাদুল্লাহ এবং বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে সাইফুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সামরিক জীবন: পরস্পরকে সুন্দর নামে সম্বোধন করা হয়। যেমন, স্টাফ জি, মেজর জি, স্যার, সাহেব ইত্যাদি। তাছাড়া বিভিন্ন ইউনিটকে বিভিন্ন উপাধিতে ডাকা হয় বা নামকরণ করা হয়।
চ. উর্দ্ধতন/ নেতার আনুগত্য করা:
নেতার বা ওলামা-ফোকাহায়ে কেরামের আনুগত্য করাও ওয়াজিব। যেমন আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ- হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। সূরা নিসা-৫৯
‘উলিল আমর’ এর পরিচয়। ‘উলিল আমর’ আভিধানিক অর্থে সে সমস্ত লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে। সে কারণেই হজরত ইবনে আব্বাস (রা.), মুজাহিদ ও হাসান বসরি (রহ.) প্রমুখ মুফাসসেরগণ ওলামা ও ফোকাহা সম্প্রদায়কে উলিল আমর সাব্যস্ত করেছেন। তাঁরাই হচ্ছেন মহানবী (ﷺ)-এর নায়েব বা প্রতিনিধি। তাঁদের হাতেই দ্বীনী ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব অর্পিত।
ক। মুফাসসেরীনের অপর এক জামাআত যাদের মধ্যে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) প্রমুখ সাহাবায়ে কেরামও রয়েছেন- বলেছেন যে, উলিল আমর -এর অর্থ হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত।
খ। এছাড়া তাফসীরে –ইবনে কাসীর এবং মাজহারীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ শব্দটির দ্বারা ওলামা ও শাসক (নেতা) উভয় শ্রেণীকেই বুঝায়। কারণ, নির্দেশ দানের বিষয়টি তাঁদের উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত। তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন(সংক্ষিপ্ত)- ২৬০ পৃষ্ঠা, মুফতি শফি (রহ.), মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক অনূদিত
হাদিসে বলা হয়েছে,
ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﻤﺮ ، ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻤﺎ ، ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻤﺮﺀ ﺍﻟﻤﺴﻠﻢ ﺍﻟﺴﻤﻊ ﻭﺍﻟﻄﺎﻋﺔ ﻓﻴﻤﺎ ﺃﺣﺐ ﻭﻛﺮﻩ ﺍﻻ ﻳﺄﻣﺮ ﺑﻤﻌﺼﻴﺔ ﻓﺈﺫﺍ ﺃﻣﺮ ﺑﻤﻌﺼﻴﺔ ﻓﻼ ﺳﻤﻊ ، ﻭﻻ ﻃﺎﻋﺔ
অর্থ: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, মুসলমানদের উপর নেতার আদেশ শোনা ও মানা অপরিহার্য কর্তব্য। চাই সে আদেশ তার পছন্দনীয় হোক, আর অপছন্দনীয় হোক। তবে হ্যাঁ, যদি আল্লাহর নাফরমানিমূলক কোন কাজের নির্দেশ হয় তবে সেই নির্দেশ শোনা ও মানার কোন প্রয়োজন নেই। বুখারি-৭১৪৪; মুসলিম-১৮৩৯; তিরমিজি-১৭০৭; আবু দাউদ-২৬২৬
সামরিক জীবন: পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠন সর্বত্র আনুগত্য এক অপরিহার্য বিষয়। এগুলির কোন স্তরে আনুগত্য না থাকলে সেটা ভালভাবে চলবে না, সেখানে নিয়ম-শৃংঙ্খলা থাকবে না। ফলে সেখানে কোন কাজ সুচারুরূপে পরিচালিতও হবে না। আর সামরিক জীবনে আনুগত্যের কোন বিকল্প নেই।
০৬. নৈতিকতা: নৈতিকতা (ইংরেজি: Morality), যার অর্থ হলো ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ। এটি মূলত উদ্দেশ্য,সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ,উচিত-অনুচিত এর পার্থক্যকারী। নৈতিকতা হলো কোনো মানদন্ড বা নীতিমালা যা নির্দিষ্ট কোন আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে।
প্রমাণ্য সংজ্ঞা:
নৈতিকতা হল সেই শৃঙ্খলা যা ভাল এবং মন্দের সাথে মোকাবিলা করে এবং নৈতিক দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতার সাথেও আচরণ করে। নৈতিকতা হল নৈতিক নীতি বা মূল্যবোধের একটি সেট।" - ক্যারল বুচহোল্টজ
নৈতিকতার দিক সমূহ: নৈতিকতা সেই মানদন্ড সমূহকে বোঝায় যা মিথ্যা, সুদ -ঘুষ, ধর্ষণ, চুরি, খুন, আক্রমণ, অপবাদ এবং জালিয়াতি থেকে বিরত থাকার যুক্তিসঙ্গত বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। সততা, সহানুভূতি এবং আনুগত্যের গুণাবলী নির্দেশ করে এমন নৈতিক মানগুলিও অন্তর্ভুক্ত করে।
এ সম্পর্কে ইসলামি নির্দেশনা:
০১.মিথ্যা:
وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ
অর্থ: মিথ্যা কথন থেকে দূরে সরে থাক। সূরা হজ-৩০
হাদিস শরিফে এসেছে-
يُطْبَعُ الْمُؤْمِنُ عَلَى الْخِلَالِ كُلِّهَا إِلّا الْخِيَانَةَ وَالْكَذِب
قال الزرقاني في الشرح على المؤطا: وَضَعّفَ الْبَيْهَقِيّ رَفْعَهُ، وَقَالَ الدّارَقُطْنِيّ: الْمَوْقُوفُ أَشْبَهُ بِالصّوَابِ، قَالَ غَيْرُهُ: وَمَعَ ذَلِكَ فَحُكْمُهُ الرّفْعُ عَلَى الصّحِيحِ ; لِأَنّهُ مِمّا لَا مَجَالَ لِلرّأْيِ فِيهِ، انْتَهَى
মুমিনের চরিত্রে সবকিছুর অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু প্রতারণা ও মিথ্যা নয়। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৬১২১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১৭০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪৪৬৯
০২.ব্যভিচার: এ সম্পর্কে কুরআন এসেছে-
Surah Al-Isra, Verse 32:
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلً
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। সূরা ইসরা-৩২
ঘুষ: حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنْ عُمَرَ بْنِ أَبِي سَلَمَةَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي فِي الْحُكْمِ . قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو وَعَائِشَةَ وَابْنِ حَدِيدَةَ وَأُمِّ سَلَمَةَ . قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ حَدِيثٌ حَسَنٌ
অর্থ:কুতায়বা (রাহঃ) ...... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিচার ক্ষেত্রে ঘুষখোর ও ঘুষদাতাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লা‘নত করেছেন। তাখরিজ: ইবনে মাজাহ ২৩১৩, জামে' তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৩৬ (আন্তর্জাতিক নং ১৩৩৬)
০৩.অপবাদ: সব ধরনের মিথ্যা অপবাদ ইসলামে হারাম। বিশেষ করে ব্যভিচারের অপবাদ। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
Surah An-Noor, Verse 23:
إِنَّ الَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ لُعِنُوا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহকালে ও পরকালে ধিকৃত এবং তাদের জন্যে রয়েছে গুরুতর শাস্তি। সূরা নূর -২৩
০৪. সুদ: আল্লাহ তাআলা বলেন,
یَمۡحَقُ اللّٰہُ الرِّبٰوا وَیُرۡبِی الصَّدَقٰتٍِ অর্থ: আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। সূরা বাকারা-
لَعَنَ رَسولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عليه وسلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ، وَقالَ: هُمْ سَوَاءٌ. অর্থ: সুদখোর সুদ দাতা এর লেখক ও সাক্ষী অভিশপ্ত। তারা সকলেই এক পর্যায়ভুক্ত। তাখরিজ:
সামরিক জীবন: সামরিক জীবনে মিথ্যা সুদ-ঘুষ, চুরি, অনৈতিক সম্পর্ক, অবৈধ সম্পদ অর্জনের কোন স্থান নেই।
উপসংহার:
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে, মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুর রাজ্জাক